জঙ্গলমহলের জেলা ঝাড়গ্রামে তাঁর বৈঠক আজ, বুধবার। খাতায়কলমে খড়্গপুর গ্রামীণ জঙ্গলমহলের মাটি নয়। তবে জেলা যে-হেতু এক সময়ের মাওবাদী প্রভাবিত পশ্চিম মেদিনীপুর, তাই সেই মঞ্চ থেকেই জঙ্গলমহলের দাবিদাওয়ার প্রতিটি পরত ছুঁয়ে গেলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অনুসারী একগুচ্ছ ঘোষণাও করলেন। বুঝিয়ে দিলেন, মাওবাদী পর্বে স্বজনহারা হোন বা পিছিয়ে পড়া লোধা-শবর সম্প্রদায়, কিংবা হাতির হানায় ক্ষতিগ্রস্ত, সকলের জন্যই তাঁর সরকার ‘মরমী’।
মঙ্গলবার খড়্গপুর গ্রামীণের বিদ্যাসাগর শিল্পতালুকে স্টেডিয়ামের মাঠে ছিল মুখ্যমন্ত্রীর প্রশাসনিক বৈঠক। সেখানেই তাঁর ঘোষণা, “জঙ্গলমহলে মাওবাদী সন্ত্রাসে আজও অনেকে নিরুদ্দেশ রয়েছেন। যাঁদের দশ বছর হয়ে গিয়েছে অথচ খবর পাওয়া যায়নি, এমন সকলের পরিবারকে ৪ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ ও পরিবারের একজনকে স্পেশাল হোমগার্ডের চাকরি দেওয়া হবে।” এমন একজনের হাতে এ দিন নিয়োগপত্র তুলেও দিয়েছেন তিনি।
পাশাপাশি মাওবাদী মোকাবিলায় এনভিএফে চাকরি পাওয়া ছেলেমেয়েদের কনস্টেবলে উন্নীত করার ঘোষণা করেছেন। মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, “মাওবাদী এলাকায় সন্ত্রাস মোকাবিলায় যে সব লোকাল ছেলেমেয়েরা জুনিয়র কনস্টেবল হয়েছিল তাদেরও ৫ বছর পূর্ণ হওয়ায় প্রোমোশন পাচ্ছে। মাওবাদী রুখতে এদের অবদানকে স্বীকৃতি জানিয়ে এটা করা হল।”
হাতির হানায় প্রাণ গেলেও সরকারি চাকরির ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর কথায়, “আমরা একটি পলিসি নিয়েছি। হাতির আক্রমণে যদি কেউ মারা যায়, তবে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। সেই সঙ্গে তাঁদের পরিবারের একজন সদস্যকে স্পেশাল হোমগার্ডে চাকরি দেওয়া হবে।”
হাথরস-কাণ্ডের প্রেক্ষিতে দলিত রাজনীতির ঢেউ লেগেছে এ রাজ্যেও। মুখ্যমন্ত্রী নিজে পথে নেমে বার্তা দিয়েছেন, দলিত-তফসিলির ‘স্বার্থবিরোধী’ বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে তাঁর লড়াই চলবে। আদিবাসী-জনজাতির ঘরে ঘরে পৌঁছতে তৃণমূল কর্মীদেরও নির্দেশ দিয়েছেন দলনেত্রী। মঙ্গল ও বুধবার মুখ্যমন্ত্রীর প্রশাসনিক বৈঠকও হচ্ছে আদিবাসী অধ্যুষিত পশ্চিম মেদিনীপুর ও ঝাড়গ্রামে। রাজনৈতিক মহলের পর্যবেক্ষণ, স্থান-কালগত এই প্রেক্ষিতও মুখ্যমন্ত্রীর এ দিনের ঘোষণার ক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ।
মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়ে ‘মাওবাদী হানায় শহিদ ও নিখোঁজ পরিবারের যৌথ মঞ্চ’-এর সম্পাদক শুভঙ্কর মণ্ডল বলেন, ‘‘প্রাক্তন মাওবাদীরা প্যাকেজ-চাকরি পেয়ে বহাল তবিয়তে আছেন। আর নিহত ও নিখোঁজদের পরিজনের সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরোচ্ছে। এই নিয়েই তো আমাদের অভিযোগ ছিল।’’
বস্তুত, জঙ্গলমহলের উন্নয়ন একটা সময় তৃণমূল সরকারের প্রচারের মুখ ছিল। পাহাড়ের পাশাপাশি জঙ্গলমহলের ‘হাসি’র কথা মুখ্যমন্ত্রী নিজেও বারবার বলেছেন। তবে ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত ভোটে তৃণমূলের আদিবাসী ভোট ব্যাঙ্কে প্রথম ধস নামে। তার পর ধাক্কাটা আসে গত বছর লোকসভায়। জঙ্গলমহলের সব আসনেই শূন্য হাতে ফিরতে হয় ঘাসফুলের প্রার্থীদের। ফলে, আগামী বছর বিধানসভা ভোটের আগে হারানো জমি পুনরুদ্ধাই লক্ষ্য তৃণমূলের। মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণাতেও স্পষ্ট, বাড়তি নজর রয়েছে জঙ্গলমহলে।

জেলার ৮টি কলেজে সাঁওতালি অর্নাস, আরও সাঁওতালি স্কুল, অলচিকির শিক্ষক নিয়োগ ও সাঁওতালি বিশ্ববিদ্যালয়ের কথাও শুনিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। মনে করিয়ে দিয়েছেন, “সব তফসিলি, আদিবাসী পরিবারে ৬০ বছর হয়ে গেলেই পেনশন দিচ্ছি আমরা।” লোধা-শবর কল্যাণ সমিতির সভাপতি বলাই নায়েকের থেকে নানা দাবিদাওয়া শুনে মুখ্যমন্ত্রী আধিকারিকদের বলেছেন, “লোধা-শবরদের বিশেষ যত্ন নাও। কোনও কাজ না-হয়ে থাকলে তবে আমার কড়া নির্দেশ দায়িত্ব নিয়ে তা করতে হবে।’’ পাশাপাশি দলের বিভিন্ন বিধায়ককেও মিলেমিশে কাজের বার্তা দিয়েছেন মমতা।
বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের অবশ্য কটাক্ষ, “পঞ্চায়েত থেকেই জঙ্গলমহলের মানুষ পরিবর্তন শুরু করেছেন। লোকসভাতেও বুঝিয়ে দিয়েছেন তৃণমূলকে দরকার নেই। তাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ সব দান-খয়রাতি করে মানুষের ভোট পাওয়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু মানুষকে ভুল বোঝানো যাবে না।”